বখাটের দখলে হাতিরঝিল
রাতের শহর মানেই হাজার বাতির গল্প। লাল, নীল, হলুদসহ নানা রঙের বাতির ঝলকানির কথা কল্পনা করলেই ভেসে ওঠে হাতিরঝিলের দৃশ্যপট। নানা রঙের আলোর ঝলকানিতে দর্শনার্থীদের কাছে টানে হাতিরঝিলের দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলী। কিন্তু রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হরেক বর্ণের আলোকচ্ছটাও মিইয়ে যেতে থাকে। সেসব স্থান গ্রাস করে অন্ধকার, দুর্বৃত্তপনার কাছে আটকে পড়ে যাবতীয় সৌন্দর্য। হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযুক্ত ৩৮টি গলি আর বাসাবাড়ির গেট ভেদ করে পৌঁছে না আলোর ঝলকানি। সেই অন্ধকারকে পুঁজি করে শতাধিক উঠতি অপরাধীর নানামুখী দৌরাত্ম্যের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে আগত মানুষ। সন্ধ্যা পেরিয়ে আধার নামতেই হাতিরঝিল চলে যায় ভবঘুরে আর মাদকসেবীদের দখলে। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে পুলিশের চেকপোস্ট থাকলেও তা কোনো কাজে আসছে না। শুক্র ও শনিবার রাতভর সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সর্বত্রই ভবঘুরে আর বখাটে মাদকসেবীদের একচ্ছত্র দখলদারিত্ব। কোথাও দল বেঁধে চলছে নেশা। বসার জন্য ইট, বালু, সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চে গভীর ঘুমে মগ্ন ভবঘুরেরা। রাতে রামপুরা পয়েন্টের অদূরে এবং এফডিসি মোড়সংলগ্ন তেজগাঁও পয়েন্টে দুটি ব্যারিকেড দেওয়া চেকপোস্ট দেখা গেলেও রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত সেখানে কোনো পুলিশ সদস্যের দেখা মেলেনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন নজরদারিহীনতায় রাতের হাতিরঝিলে ঘুরে বেড়ানো দূরের কথা, চলাচল করাও অনিরাপদ হয়ে পড়ে। হাতিরঝিল দিন দিনই উপভোগের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পরিণত হয়েছে ছিনতাইকারী, মাদকসেবী আর ভাসমান দেহজীবীদের অভয়ারণ্যে। রাত যত বাড়তে থাকে ততই যেন নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে পরিবেশ। ল্যাম্পপোস্টের আলো লেক ঢালের যেসব স্থানে পৌঁছে না, সেসব স্থানেই আখড়া গেড়েছে মাদকসেবীরা। দেখা যায়, ঝিলের সংযোগ সেতুর আশপাশেই মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের তৎপরতা বেশি। রাতে আলোস্বল্পতার সুযোগে আপত্তিকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে কেউ কেউ। চার থানার সীমানা ব্যপ্ত হাতিরঝিলে মাত্র দুটি পয়েন্টে মাঝেমধ্যে পুলিশের অবস্থান চোখে পড়লেও গোটা এলাকা থাকে অরক্ষিত। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে সমগ্র হাতিরঝিল এলাকা। রাত ১০টা পেরোতেই গুলশান পয়েন্ট দিয়ে একদল ছেলেমেয়ে ঢুকে পড়ে হাতিরঝিলে। নিকেতনঘেঁষা একটি নাইট ক্লাবের ডিজে পার্টির সদস্য তারা। এ গ্রুপের নানামুখী উচ্ছৃঙ্খলতা আর খোলামেলা মাদক সেবনে রীতিমতো হৈ-হুল্লোড় সৃষ্টি হয়, আশপাশেই জমে ওঠে সিএনজি আর রিকশার ভিড়। মেরুল-বাড্ডার রিকশাচালক রমজান আলী জানান, প্রায় প্রতি রাতেই অর্ধনগ্ন তরুণ-তরুণীদের বেলেল্লাপনা চলে এখানে। আড়ং পয়েন্টের রাস্তা ধরে ব্রিজটির নিচে লেকঘেঁষা ঢালে তরুণ-তরুণীর বিব্রতকর আড্ডাবাজি চলতে দেখা যায় রাত সোয়া ১টা পর্যন্ত। বেসরকারি রেড ফোর সিকিউরিটি সংস্থার সদস্যরা তাদের তুলে দিতেও গলদঘর্ম হচ্ছিলেন। ব্রিজের ঠিক উপরেই রাত দেড়টায় প্রাইভেটকারে তিন তরুণ ও এক তরুণী এসে নামেন। প্রকাশ্যেই মদপান আর নৃত্যে মেতে ওঠেন তারা। সিকিউরিটি সদস্যরা মদপান ও উদ্দাম নৃত্য বন্ধ করতে বলায় মারমুখী হয়ে ওঠেন তারা। সিকিউরিটি সদস্যদের ডেকে জড়ো করা হলে তরুণ-তরুণীরা দ্রুত সটকে পড়েন। হাতিরঝিল তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়া ও বেগুনবাড়ী অংশের বস্তিঘরগুলোর সঙ্গেই লাগোয়া রয়েছে ঝিলের রাস্তা-ফুটপাত। বাসিন্দারা সীমানা দেয়ালের মধ্য দিয়েই বাড়িঘরের গেট বানিয়ে নিয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত এসব বস্তির নারী-পুরুষ-শিশুরা দল বেঁধে বিচরণ করে থাকে। সেখানে বহিরাগত কোনো দর্শনার্থী গেলে নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। টিনশেড বেশকিছু বস্তিঘরের দরজা সীমানা দেয়ালে আটকে পড়লেও তারা বাঁশের মই বানিয়ে নিয়েছেন। দোতলা টিনের ঘর থেকে মই নামিয়ে দেওয়া হয় রাস্তা ও ফুটপাতে। রাত আড়াইটার দিকে এমন একটি ঘর থেকে মই বেয়ে নামতে দেখা যায় দুজনকে। তারা জানান, কারওয়ান বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী তারা, বাড়ি গাজীপুরের টোক এলাকায়। হালিমা নামে একজনের বাসায় মধ্যরাত পর্যন্ত তারা আনন্দফুর্তি শেষে চলে যাচ্ছেন। মধুবাগ পয়েন্টেও এ ধরনের বেশ কয়েকটি বাসাবাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে। হাতিরঝিলে ঘোরাফেরার সুবাদে খদ্দের জুটিয়ে দেহজীবীরা নিজেদের বাসাবাড়িতে নিয়ে যান। হাতিরঝিলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বহুমুখী অপরাধী চক্র। মাদক বাণিজ্য, দেহজীবীদের অবাধ বিচরণ, ছিনতাই, প্রতারণাসহ নানারকম অপরাধ তৎপরতা বেড়েই চলেছে। যত্রতত্র প্রকাশ্যে মাদক সেবন হয়ে পড়ছে মামুলি ব্যাপার।
কারওয়ান বাজারের দিক থেকে প্রবেশপথের ডান দিকে আলোর ব্যবস্থা নেই। এরকম আরও কয়েকটি স্থানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই। প্রকল্পের মগবাজার ও তেজগাঁও এলাকার আশপাশে রয়েছে কিছু বস্তি এলাকার সংযোগ। চোরাগোপ্তা পথ তৈরি করা আছে। আর এসব এলাকাকে ঘিরে চলে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ। লেকের চারপাশজুড়ে লাগানো সেই সবুজ এখন অনেকটাই বিবর্ণ। শুকিয়ে গেছে ফুলের বাগান। সন্ধ্যার পর সেতুগুলোয় বাহারি বাতির ঝলকানিও মিইয়ে যেতে শুরু করেছে। সড়কদ্বীপের অনেক বাতিই বিকল হয়ে পড়েছে। এফডিসি মোড় হয়ে হাতিরঝিলের শুরুতেই অন্ধকার। রামপুরা পয়েন্টে ১২টি বাতির নয়টিতেই আলো নেই। ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়ে গেছে। এদিকে, অযত্ন-অবহেলায় শ্রীহীন হাতিরঝিল দিন দিনই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ গড়ে না ওঠা, রক্ষণাবেক্ষণে অর্থের জোগান না থাকা, মাত্রাতিরিক্ত বখাটেপনা, মাদকসহ অসামাজিক কার্যকলাপের দৌরাত্ম্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে হাতিরঝিল এখন পর্যটকদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তার পাশে লাগানো হয়নি সারি সারি গাছ। গড়ে তোলা হয়নি সবুজের আচ্ছাদন, অস্তিত্ব নেই ফুলবাগানের। কিছু খেজুর আর তাল গাছের চারা রোপণ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে রাজউক। অযত্ন-অবহেলায় এরই মধ্যে পরিবেশ নোংরা হয়ে পড়েছে। লেকের পানিতে ময়লা-আবর্জনা, শিল্পবর্জ্য, প্লাস্টিকের বোতল, ভাসছে চিপসের প্যাকেটও। কালচে পানি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারপাশে। পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য ও কারওয়ান বাজারের বর্জ্য লেকে মিশে একাকার। মাছ চাষের পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তব রূপ পাচ্ছে না।
No comments:
Post a Comment