আত্মসমর্পণের পর সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। তিনি জামিন চাননি। কারাগারে ডিভিশন (বিশেষ মর্যাদা) পাওয়া বন্দীদের জন্য নির্ধারিত ২৬ নম্বর সেলে তাঁকে একা রাখা হয়েছে।
লতিফ সিদ্দিকী গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। রোববার রাতে তিনি ভারত থেকে ঢাকায় ফেরেন এবং অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের ১৮টি জেলায় ২২টি মামলা হয়। অন্তত সাতটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের চারটি পরোয়ানা রয়েছে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে পবিত্র হজ, তাবলিগ জামাত ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে নানা মন্তব্য করেন লতিফ সিদ্দিকী। বিদেশে থাকা অবস্থায়ই মন্ত্রিসভা ও দল থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক জানান, গতকাল বেলা দেড়টার দিকে আচমকা তাঁর কক্ষে ঢুকে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘ওসি সাহেব, চলে এলাম আপনার কাছে।’ সাবেক মন্ত্রীকে দেখে কিছুটা চমকে গেলেও সামলে নিয়ে ওসি বলেন, ‘ভালোই হয়েছে স্যার, পুলিশ তো আপনাকে খুঁজছে।’ লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘পুলিশ আমাকে খুঁজবে কেন, আমি নিজেই চলে এসেছি।’ এরপর ওসি তাঁকে চা পান করতে বলেন। লতিফ সিদ্দিকী তাতে রাজি হননি। বললেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া কী আছে, কী করতে হবে তা করেন।’
ওসি আবু বকর প্রথম আলোকে বলেন, এরপর তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নির্দেশনা পেয়ে নিজের গাড়িতে করেই লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে পুরান ঢাকায় আদালতের দিকে রওনা দেন। সব মিলিয়ে থানায় তিন থেকে চার মিনিট ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী।
ধানমন্ডি থানার সেন্ট্রি ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা জানান, একটি সিএনজি অটোরিকশায় করে একাই থানায় আসেন লতিফ সিদ্দিকী। তাঁর পরনে ছিল কালো প্যান্ট আর সাদা চেক শার্ট, শার্টের পকেটে একটি কলম গোঁজা। থানায় ঢুকেই তিনি সরাসরি ওসির কক্ষে চলে যান।
আদালতে নেওয়ার সময় লতিফ সিদ্দিকীকে বহনকারী গাড়ির সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের আরও দুটি গাড়ি সামনে-পেছনে যায়। বেলা দুইটার দিকে লতিফ সিদ্দিকী আদালতে পৌঁছান। এর মধ্যেই গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়। সাংবাদিকেরা আদালতের দিকে ছুটে যান। এর মধ্যেই আদালত এলাকার নিরাপত্তায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীকে বহন করা গাড়িটি ঘিরে ধরে তাঁকে নামিয়ে আনেন এবং মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের পাশে হাজতখানায় নিয়ে যান। সোয়া দুইটার দিকে তাঁকে দোতলায় আদালতকক্ষে নিয়ে যায় পুলিশ। এ সময় নিরাপত্তার জন্য লতিফ সিদ্দিকীকে হেলমেট পরাতে চায় পুলিশ। তিনি হেলমেট পরতে রাজি হননি।
জনাকীর্ণ আদালতে প্রায় ১৫ মিনিটের শুনানির পুরো সময় লতিফ সিদ্দিকী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। মহানগর হাকিম আতিকুর রহমান এজলাসে ওঠার পরে মামলার বাদী আইনজীবী এ কে এম আবেদ রাজা আদালতকে বলেন, ২০০ কোটি ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে এই মামলাটি করা হয়েছে। আসামি লতিফ সিদ্দিকী নিজে এবং তাঁর বাবাও একজন আইনজীবী ছিলেন। এই মামলায় যা কিছু আইনগত সুযোগ-সুবিধা আসামি পাবেন, তাতে বাদীর কোনো আপত্তি নেই।
এরপর হাকিম লতিফ সিদ্দিকীর কাছে জানতে চান, তিনি জামিনের আবেদন করবেন কি না। জবাবে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি জামিনের আবেদন করব না।’ হাকিম বলেন, ‘যেহেতু আসামি জামিনের আবেদন করেননি, তাই আসামি পরোয়ানামূলে জেলহাজতে যাবেন।’
আদেশের পরপর আদালতকক্ষেই চিৎকার করে উল্লাস করা শুরু করেন আইনজীবীরা। উল্লাস করতে করতে তাঁরা নিচে নেমে মিছিল শুরু করেন। এ সময় অনেক আইনজীবীকে হাতে জুতা তুলে নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়।
বেলা পৌনে তিনটার দিকে প্রিজন ভ্যানে করে লতিফ সিদ্দিকীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। আদালত চত্বর থেকে বের হওয়ার সময় কিছু আইনজীবী প্রিজন ভ্যানে জুতা ছুড়ে মারেন।
কারা ফটকে ১৭ মিনিট: বেলা সাড়ে তিনটার দিকে লতিফ সিদ্দিকীকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান বকশীবাজারে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে পৌঁছায়। প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে কারাগারে ঢোকার জন্য কয়েক পা এগিয়েই ফটকের সামনে থেমে যান তিনি। বলেন, পকেট (ছোট) গেট দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকবেন না। পুলিশ কর্মকর্তা ও কারারক্ষীরা তাঁকে অনুরোধ করেন, চাপাচাপিও করেন। তখন তিনি বলেন, ‘আমি এখনো এমপি। আমি গত ৩০ বছর ছোট গেট দিয়ে চলাচল করিনি।’
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকটি সাধারণত গাড়ি ও মালামাল আনা-নেওয়ার সময় খোলা হয়। আর আসামিদের ছোট ফটক দিয়ে আনা-নেওয়া করা হয়।
এই অচলাবস্থার সময় গণমাধ্যমের কর্মীরা লতিফ সিদ্দিকীর ছবি তুলছিলেন। অনেকে দূর থেকে উচ্চস্বরে তাঁর উদ্দেশে বিভিন্ন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিলেন। তবে কারোর প্রশ্নেরই জবাব দেননি লতিফ সিদ্দিকী। শুধু দুই দিকে মাথা ঝাঁকিয়েছেন। দুই হাত এক করে মুখ বরাবর তুলে এনে কথা বলবেন না বলে ইশারা করেন সবার উদ্দেশে।
শেষ পর্যন্ত বিকেল পৌনে চারটার দিকে কারাগারের প্রধান ফটকটি খুলে দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী ফটকের বাইরে আসেন এবং লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে হেঁটে কারাগারে ঢোকেন।
জানতে চাইলে ফরমান আলী বলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে কারাগারে ঢোকানোর ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
কারা সূত্র জানায়, সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী হিসেবে লতিফ সিদ্দিকীকে কারাগারে ডিভিশন পাওয়া বন্দীদের জন্য নির্ধারিত ২৬ নম্বর সেলে নিয়ে রাখা হয়। তিনি যে শার্ট-প্যান্ট পরে এসেছিলেন, সেগুলো পরেই সেলে গেছেন। পরে তাঁর আত্মীয় পরিচয়ে একজন গিয়ে শীতের কিছু কাপড় দিয়ে আসেন। ওই সেলে গত রাতে তিনি একাই ছিলেন বলে কারাসূত্র জানায়। ওই সেলে তাঁর সঙ্গে অন্য কাকে রাখা যায়, সে বিষয়ে আজ সিদ্ধান্ত নেবে কারা কর্তৃপক্ষ। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আজ থেকে তাঁর সেবার জন্য একজন বন্দীকেও নিয়োগ করা হবে।