মাশরাফির সামনে নতুন অধ্যায়
দিনটি নিশ্চয়ই ভোলেননি মাশরাফি বিন মুর্তজা!
৫ অক্টোবর, ২০১০। জীবনের পথচলায় ২৭ পূর্ণ করেছিলেন সেদিন। দিনটি আরও স্মরণীয় হলো, যখন দেশের মাটিতে টস করতে নামলেন প্রথমবার। বাংলাদেশ অধিনায়ক! এক চার ও এক ছক্কায় ১৫ রান করেছিলেন ব্যাটিংয়ে। বোলিংয়ে কেবল শুরু করেছেন। দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলটি করতে গিয়ে বেকায়দায় পা ফেলে মচকে ফেললেন অ্যাঙ্কেল। সতীর্থ শফিউল আর ফিজিওর কাঁধে ভর করে মাঠ ছাড়তে হলো। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দলের দারুণ জয় দেখলেন ড্রেসিংরুমে বসে। পরে বললেন, ‘দলের জয়ে নিজের ব্যথা ভুলে গেছি। আমার জন্য এটি জন্মদিনের দারুণ উপহার।’
সেই অম্ল-মধুর স্বাদ পরে সিরিজজুড়েই সঙ্গী হয়েছে মাশরাফির। ওই চোটে সিরিজেই আর ফেরা হয়নি মাশরাফির। মাঠের বাইরে থেকে দেখেছেন ব্যাটে-বলে অসাধারণ পারফরম্যান্সে নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাইয়ে নেতৃত্ব দিলেন সাকিব আল হাসান।
মাশরাফি বা সাকিব, কারও জন্যই অবশ্য অভিজ্ঞতাটি নতুন ছিল না। ওই ঘটনার ১৩ মাস আগে, বাংলাদেশ দল তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। মাশরাফি সেবার প্রথম মেয়াদে অধিনায়ক। সেন্ট ভিনসেন্টে প্রথম টেস্টের তৃতীয় দিন সকালে বোলিং করতে গিয়ে বেকায়দায় পা ফেলে পড়ে গেলেন। এবার চোট হাঁটুতে, মাঠ ছাড়লেন শাহাদাত ও এনামুল জুনিয়রের কাঁধে ভর দিয়ে। দায়িত্ব নিয়ে টেস্টে তো বটেই, পরে ওয়ানডে সিরিজেও দলকে ধবলধোলাইয়ে নেতৃত্ব দিলেন সাকিব।
অথচ দুবারই ধবলধোলাইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া অধিনায়কের নাম হতে পারত মাশরাফি। ব্যাটে-বলে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাকিব, তবে মাশরাফি থাকলে দলের শক্তি বাড়ত বৈ কমত না! বরাবরের মতো ভাগ্য বিদ্রোহ করল বলেই সেই দুবার ধবলধোলাইয়ের গৌরবের পাশে লেখা হলো না মাশরাফির নাম। এরপর যথারীতি অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন মাশরাফি। আরও কয়েকবার চোট পেয়ে ছিটকে গেছেন, ফিরে এসেছেন আবার লড়াই করে। ক্যারিয়ারজুড়ে ক্রিকেট–বিধাতার নিষ্ঠুর আচরণ পেয়ে আসা মাশরাফি হঠাৎই পেয়েছেন একটু সুনজর। আবার অধিনায়ক হয়েছেন। আজ সুযোগও এসে গেছে দলকে ধবলধোলাইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার। সুযোগ, সেই দুবারের আক্ষেপ ঘোচানোর!
আক্ষেপ! শব্দটা শুনে হাসলেন মাশরাফি। শেষবার চোট থেকে ফেরার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে এই মাশরাফিকে। ক্যারিয়ারটাই তাই হাজারো আক্ষেপের গল্প। আক্ষেপে গাঁথা কষ্টের মালা তাই আর গলায় পরতে চান না বাংলাদেশ অধিনায়ক। বারবার বলছেন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব না মিলিয়ে ক্যারিয়ারের বাকিটা শুধু উপভোগ করতে চান।মাশরাফি বিন মুর্তজা
কালও কণ্ঠে একই কথা। নিজের অর্জনের চেয়ে দলের প্রাপ্তির রোমাঞ্চই বেশি ছুঁয়ে যাচ্ছে মাশরাফিকে, ‘আগে যেটা করতে পারিনি, এখন সেটা পারব বলে যে আলাদা শান্তি পাব, তেমন কিছু আসলে মনে হচ্ছে না। ৫-০ করতে পারলে দলের জন্য দারুণ হয়, সেটিই আছে ভাবনায়। এ বছর আমরা অনেকগুলো মাচ জিততে জিততে হেরে গেছি। একটি জয়ের সুযোগও তাই আর হাতছাড়া করতে চাই না। আর এই যে দল খারাপ সময় থেকে বেরিয়ে এসেছে, এ জন্য প্রতিটি ক্রিকেটারের আলাদা করে কৃতিত্ব প্রাপ্য। ৫-০ করতে পারলেও কৃতিত্ব সবার প্রাপ্য, শুধু অধিনায়কের নয়।’
ভাগ্যের পালাবদলের পালায় আরেকটি দারুণ প্রাপ্তিও এখন মাশরাফির অপেক্ষায়। দেশের মটিতে গত বিশ্বকাপ খেলতে না পারার যন্ত্রণায় চোখের পানি ঝরিয়েছিলেন সবার সামনেই। এবার যদি দুর্ভাগ্য আবার সঙ্গী না হয়, তবে আসন্ন বিশ্বকাপে মাশরাফির নেতৃত্বেই অস্ট্রেলিয়া যাবে বাংলাদেশ। চ্যালেঞ্জ একটিই, নিজেকে ফিট রাখা! মাশরাফিও নিজেকে ফিট রাখতে চান। তবে সেটি অধিনায়কত্বের টানে নয়, দেশের হয়ে খেলার তাড়নায়, ‘অধিনায়কত্বের জন্য আমি কোনো চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি না। নিতে চাই না। চ্যালেঞ্জ নিতে চাই খেলার জন্য। অধিনায়ক রাখা না-রাখা বোর্ডের ব্যাপার। আমি সাধারণ একজন হিসেবে খেলে যেতে পারলেই খুশি।’
দল অন্তঃপ্রাণের কাছ থেকে এমন কথাই কাম্য। কিন্তু ক্রিকেটবিধাতা এত কিছু কেড়ে নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে যে এই প্রাপ্তির হাতছানিগুলোও তাঁর প্রাপ্য। আজ ধবলধোলাইয়ে নেতৃত্ব, কদিন পর দলকে নেতৃত্ব দিন বিশ্বকাপে। মাশরাফির হার না মানা অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ারে যোগ হোক না আরও কিছু চমকপ্রদ অধ্যায়!
No comments:
Post a Comment